১৩- আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী ইসলাম

১৩- আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী ইসলাম

বাপ-মায়ের স্মৃতি যেমন সন্তানের রক্তের সঙ্গে  জড়িত,  প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্মৃতি তেমনি মুসলিম জীবনের প্রতি স্তরের সঙ্গে জড়িত। বছরের একদিন, দু’দিন বা মাস ব্যাপী মীলাদুন্নবী, সীরাতুন্নবী, ইয়াওমুন্নবী বা দা‘ওয়াতুন্নবীর জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা বরং নবীর চিরন্তন আদর্শকে খাটো করারই শামিল। ইসলামী সংস্কৃতিতে একারণেই কারো জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী বা অন্য কোন বার্ষিকী পালনের অনুমতি নেই। এমনকি অতি পবিত্র জুম‘আর দিবসকে ছিয়াম ও রাত্রিকে ইবাদতের জন্য খাছ করে নিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন’।[26] বার্ষিকী পালনের রেওয়াজ বিভিন্ন মুসলিম দেশে অমুসলিমদের অনুকরণে চালু হয়। মরক্কোতে বার্ষিকী পালনকে ‘মওসুম’ (موسَم) বলে। কারণ তারা বছরে একবার উৎসব আকারে এটা পালন করে। আলজিরিয়ায় ‘যারদাহ’(زردة) বলা হয়। কেননা তারা ‘অলি’র নামে উৎসর্গীত খানা-পিনায় বরকত আছে মনে করে খুব জলদি খেতে ভালবাসে। কোন কোন দেশে এটাকে ‘হযরত’ (حضرت) বলা হয় লোকদের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে অথবা তাদের বিশ্বাসমতে ঐ অনুষ্ঠানে তাদের প্রিয় অলি বা ভক্তিভাজন ব্যক্তির রূহ মুবারক হাযির হওয়ার কারণে। তবে মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যত্র জন্মবার্ষিকীকে বিশেষভাবে ‘মাওলিদ’ (مولد) বলা হয়। অতঃপর ঐসব অনুষ্ঠানের পরিধি ও উপাচার-উপাদান তার আয়োজকদের সচ্ছলতার হিসাবে কমবেশী হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উৎসবের সাধারণ রীতি অনুযায়ী প্রচুর খানা-পিনা, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, নাচ-গান, বাদ্য-বাজনা, মেলা বসানো ও সাথে সাথে মৃত অলি বা ভক্তিভাজন ব্যক্তির উদ্দেশ্যে জোরে-শোরে নিজেদের কামনা-বাসনা নিবেদন ইত্যাকার হরেক রকমের অনুষ্ঠানে  এইসব বার্ষিকীগুলি মুখর থাকে।

তবে বার্ষিকী পালন ও উদযাপনে সরকারী উৎসাহ-উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে কাজ করে থাকে। ইচ্ছায় হৌক অনিচ্ছায় হৌক সরকারী সুবিধাদির সুযোগে বা লৌকিকতার কারণে অনেকে এইসব শিরক ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠানে যোগদান বা সহযোগিতা করতে বাধ্য হন। ক্রমেই এটা একপ্রকার রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। যেমন বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশে সরকারী ও বেসরকারীভাবে এটা নিয়মিত ও সাধারণ অনুষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। আলেম সমাজের কাছেও এটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। অথচ ধর্মের নামে এইসব বাড়তি ও বাজে খরচের অনুষ্ঠানে কত কোটি কোটি টাকা যে প্রতি বৎসর মুসলমানের ঘর থেকে চলে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজে ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অহেতুক বিবাদের ও মন কষাকষির কারণ হচ্ছে, তার খবর কে রাখে? সর্বোপরি এই সব অনুষ্ঠান মুসলিম জীবনের সহজ-সরল জীবনধারাকে যে নির্মম আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব করে ফেলে, তার চাইতে বড় ক্ষতি দুনিয়াতে আর কিছুই  হ’তে পারে না। এছাড়া আখেরাতে জাহান্নামের  কঠোর শাস্তি তো আছেই।

একদা ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হিঃ) স্বীয় ছাত্র ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪ হিঃ)-কে বলেন,

إِنَّ كُلَّ مالم يَكُنْ على عهد رسولِ اللهِ (ص) وأصحابِه دِينًا لم يَكُنِ اليومَ دينًا وقال: مَنِ ابْتَدَعَ فى الإسلامِ بدعةً فَرَأَها حسنةً فقد زَعَمَ أنَّ محمدًا (ص) قد خَانَ الرسالةَ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীদের সময়ে যেসব বিষয় ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত ছিল না, বর্তমানকালেও তা ‘দ্বীন’ হিসাবে গৃহীত হবে না। যে ব্যক্তি ধর্মের নামে ইসলামে কোন নতুন প্রথা চালু করল, অতঃপর তাকে ভাল কাজ (বা ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’) বলে রায় দিল, সে ধারণা করে নিল যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় রিসালাতের দায়িত্ব পালনে খেয়ানত করেছেন’ (নাঊযুবিল্লাহ)।[27]

আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম ও ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম… (মায়েদাহ ৩)

এই সব বার্ষিকী ইসলামের স্বর্ণযুগে পরিপূর্ণ দ্বীনের মধ্যে ছিল না বরং বিভ্রান্তির যুগে ইসলামের লেবাস পরিধান করে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। এসব থেকে দূরে থাকা আমাদের একান্তভাবেই ধর্মীয় কর্তব্য।

দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে ইসলাম বন্দী হয়ে পড়েছে সরকারী ও বেসরকারী কতকগুলি রেওয়াজ ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের  আলোকে গড়ে  তুলবার নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব যেন মুসলমান  আজ ভুলতে বসেছে।

 

[26] . মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫২ নফল ছিয়ামঅনুচ্ছেদ।

[27] . আল-ইনছাফ, পৃঃ ৩২।

This entry was posted in 02. মীলাদ প্রসঙ্গ, 13. আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী ইসলাম. Bookmark the permalink.

Leave a comment