কুরবানীর মাসায়েল
(১) চুল-নখ না কাটা: উম্মে সালামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ وَ أَرَادَ بَعْضُكُمْ أَنْ يُّضَحِّىَ فَلاَ يَمُسَّ مِنْ شَعْرِهِ وَ أَظْفَارِهِ شَيْئًا رواه مسلم و زاد النسائىُّ: حَتَّى يُضَحِّىَ-
‘তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেওয়ার এরাদা রাখে, তারা যেন যিলহাজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার পর হ’তে কুরবানী সম্পন্ন করা পর্যন্ত স্ব স্ব চুল ও নখ কর্তন করা হ’তে বিরত থাকে’।[1]
(খ) কুরবানী দিতে অক্ষম ব্যক্তিগণ কুরবানীর খালেছ নিয়তে এটা করলে ‘আল্লাহ্র নিকটে তা পূর্ণাঙ্গ কুরবানী’ হিসাবে (فذلك تمامُ أُضحِيَتِكَ عِنْدَ الله) ’ গৃহীত হবে।[2]
(গ) ইমাম নববী বলেন, ‘উহার তাৎপর্য হ’ল যাতে অকর্তিত নখ চুল সহ পূর্ণাঙ্গ দেহ নিয়ে মুমিন বান্দা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পায়’।[3] তাছাড়া এর তাৎপর্য এটাও হ’তে পারে যে, ইসমাঈল (আঃ) হাসিমুখে তাঁর জীবন দিয়ে আল্লাহ্র হুকুম পালন করেছিলেন। তার অনুসরণে আমরা আমাদের দেহের একটা অংশ নখ-চুল ইত্যাদি কুরবানী দিয়ে মনের মধ্যে এই সংকল্প করতে পারি যে, আল্লাহ্র দ্বীনের খাতিরে প্রয়োজনে আমরাও ইসমাঈলের ন্যায় জীবন কুরবানী দিতে প্রস্ত্তত। এর ফলে আমরা নবীর সুন্নাত অনুসরণের নেকী তো পাবই, উপরন্তু ‘দ্বীনের জন্য মুজাহিদ বেশে মৃত্যুবরণের আকাংখা পোষণের কারণে ‘মুনাফেকী হালতে মৃত্যুবরণ’ থেকে বেঁচে যাব ইনশাআল্লাহ।[4]
দুর্ভাগ্য, এই সুন্নাতটি বর্তমানে মুসলিম সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছে।
(২) কুরবানীর পশু:
(ক) উহা তিন প্রকারঃ উট, গরু ও ছাগল। দুম্বা ও ভেড়া ছাগলের মধ্যে গণ্য। প্রত্যেকটির নর ও মাদি। এগুলির বাইরে অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করার প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না।[5] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, ‘উপরে বর্ণিত পশুগুলি ব্যতীত অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হবে না’।[6]
(খ) ছাগল কুরবানী করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় থাকাকালীন সময়ে উট, গরু পাওয়া সত্ত্বেও সর্বদা ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন।[7] ইসমাঈলের বিনিময়ে জান্নাতী পশুর যে কুরবানী দেওয়া হয়, সেটাও ছিল দুম্বা। তবে রক্ত প্রবাহিত করার বিবেচনায় জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে উত্তম হ’ল উট অতঃপর গরু অতঃপর দুম্বা ও ছাগল-ভেড়া।[8]
(গ) ‘খাসি’ কুরবানী নিঃসন্দেহে জায়েয বরং উত্তম। কারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় মুক্বীম এমনকি মুসাফির অবস্থায়ও সর্বদা দু’টি করে ‘খাসি’ (مَوْجُوْئَيْنِ) কুরবানী দিতেন।[9] ছহীহ বুখারীর সর্বশেষ ভাষ্যকার আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, ‘খাসি’ করার কারণে কেউ কেউ এটাকে খুঁৎওয়ালা পশু বলে অপসন্দ করেছেন। কিন্তু মূলতঃ এটি কোন খুঁৎ নয়। বরং এর ফলে গোশত রুচিকর হয়, দুর্গন্ধ দূরীভূত হয় ও সুস্বাদু হয়।[10] ইবনু কুদামা বলেন, খাসিই কুরবানীর জন্য যথেষ্ট। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দু’টি খাসি দিয়েই কুরবানী করতেন।[11] সূরায়ে নিসা ১১৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় সাধারণভাবে পশুকে দাগানো ও খাসি না করা বিষয়ে কয়েকজন ছাহাবী ও তাবেঈর মতামত[12] কুরবানীর পশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের নিয়মিত আমলই অগ্রগণ্য ও অনুসরণীয়।
(ঘ) কুরবানীর পশু সুঠাম, সুন্দর ও নিখুঁত হওয়া চাই। চার ধরনের পশু কুরবানী করা নাজায়েয। যথাঃ স্পষ্ট খোঁড়া, স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগী ও জীর্ণশীর্ণ এবং অর্ধেক কান কাটা বা ছিদ্র করা ও অর্ধেক শিং ভাঙ্গা।[13] এসবের চাইতে নিম্নস্তরের কোন দোষ যেমন অর্ধেক লেজ কাটা ইত্যাদি থাকলে তার দ্বারাও কুরবানী হবে না। তবে নিখুঁত পশু ক্রয়ের পর যদি নতুন করে খুঁৎ হয় বা পুরানো কোন দোষ বেরিয়ে আসে, তাহ’লে ঐ পশু দ্বারাই কুরবানী বৈধ হবে।[14]
(৩) ‘মুসিন্নাহ’ দ্বারা কুরবানী:
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تَذْبَحُوْ ا إِلاَّ مُسِنَّةً إِلاَّ أَنْ يَّعْسُرَ عَلَيْكُمْ فَتَذْبَحُوْا جُذْعَةً مِّنَ الضَّأْنِ رواه مسلم –
অর্থঃ ‘তোমরা দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত ওঠা (মুসিন্নাহ) পশু ব্যতীত যবহ করো না। তবে কষ্টকর হ’লে এক বছর পূর্ণকারী ভেড়া (দুম্বা বা ছাগল) কুরবানী করতে পার’।[15]জমহূর বিদ্বানগণ অন্যান্য হাদীছের আলোকে এই হাদীছে নির্দেশিত ‘মুসিন্নাহ’ পশুকে কুরবানীর জন্য ‘উত্তম’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[16]
‘মুসিন্নাহ’ পশু ষষ্ঠ বছরে পদার্পণকারী উট এবং তৃতীয় বছরে পদার্পণকারী গরু বা ছাগল-ভেড়া-দুম্বাকে বলা হয়।[17] কেননা এই বয়সে সাধারণতঃ এই সব পশুর দুধে দাঁত ভেঙ্গে নতুন দাঁত উঠে থাকে। তবে অনেক পশুর বয়স বেশী ও হৃষ্টপুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সঠিক সময়ে দাঁত ওঠে না। এসব পশু দ্বারা কুরবানী করা ইনশাআল্লাহ কোন দোষের হবে না।
(৪) নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি পশুই যথেষ্ট:
(ক) মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন…. অতঃপর নিম্নোক্ত দো‘আ পড়লেন,
بِسْمِ اللهِ أَللّهُمَّ تَقَبَّلْ مِن مُّحَمَّدٍ وَّ آلِ مُحَمَّدٍ وَّ مِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ رواه مسلم-
‘আল্লাহ্র নামে (কুরবানী করছি), হে আল্লাহ! তুমি এটি কবুল কর মুহাম্মাদের পক্ষ হ’তে, তার পরিবারের পক্ষ হ’তে ও তার উম্মতের পক্ষ হ’তে’। এরপর উক্ত দুম্বা দ্বারা কুরবানী করলেন’।[18]
(খ) বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
يَآ أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِىْ كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَةً وَ عَتِيْرَةً… رواه الترمذي وابوداؤد-
‘হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও আতীরাহ’। আবুদাঊদ বলেন, ‘আতীরাহ’ প্রদানের হুকুম পরে রহিত করা হয়।[19]
(গ) ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিবার পিছু একটি করে বকরী কুরবানীর রেওয়াজ ছিল। যেমন ছাহাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ) বলেন,
كَانَ الرَّجُلُ يُضَحِّىْ بِالشَّاةِ عَنْهُ وَ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ فَيَأْكُلُوْنَ وَ يُطْعِمُوْنَ حَتَّى تُبَاهِىَ النَّاسُ فَصَارَتْ كَمَا تَرَى رواه الترمذى وابن ماجه-
অর্থঃ ‘একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হ’তে কুরবানী দিতেন। অতঃপর তা খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন এবং এভাবে লোকেরা বড়াই করত। এই নিয়ম রাসূলের যুগ হ’তে চলে আসছে যেমন তুমি দেখছ’।[20]
(ঘ) একই মর্মে ধনাঢ্য ছাহাবী আবু সারীহা (রাঃ) প্রমুখাৎ ছহীহ সনদে বর্ণিত ইবনু মাজাহ্র একটি হাদীছ[21] উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানী বলেন, والحق أنها ةجزئ عن أهل البية و إن كانوا مائة نفس أو أكثر كما قضة بذلك السنة ‘সঠিক কথা এই যে, একটি বকরী একটি পরিবারের পক্ষ হ’তে যথেষ্ট, যদিও সেই পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয় এবং এভাবেই নিয়ম চলে আসছে’।[22]
(ঙ) মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, যারা একটি ছাগল একজনের জন্য নির্দিষ্ট বলেন এবং উক্ত হাদীছগুলিকে একক ব্যক্তির কুরবানীতে পরিবারের সকলের ছওয়াবে অংশীদার হওয়ার ‘তাবীল’ করেন বা খাছ হুকুম মনে করেন কিংবা হাদীছগুলিকে ‘মানসূখ’ বলতে চান, তাঁদের এইসব দাবী প্রকাশ্য ছহীহ হাদীছের বিরোধী এবং তা প্রত্যাখ্যাত ও নিছক দাবী মাত্র’।[23]
(চ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হ’তে দু’টি করে ‘খাসি’ এবং হজ্জের সফরে মিনায় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।[24]
(৫) কুরবানীতে শরীক হওয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,
كُنَّا مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ فِىْ سَفَرٍ فَحَضَرَ الْأَضْحَى فَاشْتَرَكْنَا فِى الْبَقَرَةِ سَبْعَةٌ وَ فِى الْبَعِيْرِ عَشَرَةٌ رواه الترمذى والنسائى وابن ماجه بإسناد صحيح كما قاله الألبانى-
(ক) অর্থঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কুরবানীর ঈদ উপস্থিত হ’ল। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হ’লাম’।[25]
(খ) হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহ্র রাসূলের সাথে হজ্জ ও ওমরাহ্র সফরে সাথী ছিলাম।… তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম’।[26]সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়। যাতে গরু বা উটের ন্যায় বড় পশু যবহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বন্টন সহজ হয়। জমহূর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদ্ঈর ন্যায় কুরবানীতেও শরীক হওয়া চলবে।[27]
(গ) হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এর অধিক) দাঁড়ানো অবস্থায় ‘নহর’ করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দু’টি সুন্দর শিংওয়ালা ‘খাসি’ কুরবানী করেছেন’। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হ’তে একটি গরু কুরবানী করেন’।[28] অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলি ছাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হ’তে পারে।
আলোচনা: ইবনু আববাস (রাঃ)-এর হাদীছটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি মুসলিম ও আবুদাঊদে এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি বুখারীতে সংকলিত হয়েছে। মুসলিম ও বুখারীতে যথাক্রমে ‘হজ্জ’ ও ‘মানাসিক’ অধ্যায়ে এবং সুনানে ‘কুরবানী’ অধ্যায়ে হাদীছগুলি এসেছে। যেমন (১) তিরমিযী ‘কুরবানীতে শরীক হওয়া’ অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রাঃ) থেকে মোট তিনটি হাদীছ এনেছেন। যার মধ্যে প্রথম দু’টি সফরের কুরবানী ও শেষেরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।[29](২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস, জাবের, আবু হুরায়রা ও আয়েশা (রাঃ) হ’তে যে পাঁচটি হাদীছ (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলিই সফরে কুরবানী সংক্রান্ত। (৩) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) থেকে পূর্বের দু’টি হাদীছ (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন (৪) আবুদাঊদ শুধুমাত্র জাবির (রাঃ)-এর পূর্ব বর্ণিত সফরে কুরবানীর হাদীছটি এনেছেন তিনটি ছহীহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদীছটিতে اَلْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْجَزُوْرُ عَنْ سَبْعَةٍ) ) কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিভ্রাটের কারণ: মিশকাত শরীফে ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সফরের হাদীছটি (নং ১৪৬৯) এবং জাবির (রাঃ) বর্ণিত ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটি (নং ১৪৫৮) সংকলিত হয়েছে।সম্ভবতঃ জাবির (রাঃ) বর্ণিত ‘মুত্বলাক্ব’ বা ব্যাখ্যাশূন্য হাদীছটিকে ভিত্তি করেই এদেশে মুক্বীম অবস্থায় গরুতে সাতভাগা কুরবানীর প্রথা চালু হয়েছে। অথচ ভাগের বিষয়টি সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ইবনু আববাস ও জাবির (রাঃ) বর্ণিত বিস্তারিত হাদীছে উল্লেখিত হয়েছে।[30] আর একই রাবীর বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদীছের স্থলে বিস্তারিত ও ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদীছ দলীলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করাই মুহাদ্দিছগণের সর্ববাদী সম্মত রীতি।
তাছাড়া মুক্বীম অবস্থায় মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরাম কখনো ভাগে কুরবানী করেছেন বলেও জানা যায় না। ইমাম মালেক (রহঃ) কুরবানীতে শরীক হওয়ার বিষয়টিকে মকরূহ মনে করতেন।[31] দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এদেশে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়, বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের সাত -এর অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি গরু কুরবানী দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে অনেকের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে ভাগা নিয়ে অনাকাংখিত বিবাদ ও মনকষাকষি।
পরিশেষে যদি কেউ বলেন, মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর ব্যাপারে তো কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। উত্তরে বলা চলে যে, এ ব্যাপারে তো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কোন নির্দেশ বা আমলও নেই। অথচ কুরবানী হ’ল একটি ইবাদত। যা রাসূলের তরীকা অনুযায়ী সম্পন্ন করা অপরিহার্য। যেটা তিনি বলেছেন বা করেছেন, সেটাই শরী‘আত। যা তিনি বলেননি বা করেননি, সেটা শরী‘আত নয়। যেটা তিনি করেননি সেটা করার মাধ্যমে কিভাবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি হাছিল করা যাবে?
বিগত বিদ্বানগণের যুগে সম্ভবতঃ মুক্বীম অবস্থায় ভাগা কুরবানীর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। যেমন আজকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কুরবানীর সাথে একটি গরুর ভাগা নেওয়া হচ্ছে মূলতঃ গোশত বেশী পাবার স্বার্থে। ‘নিয়ত’ যখন গোশত খাওয়া, তখন কুরবানীর উদ্দেশ্য কিভাবে হাছিল হবে? অনেকে হাযার হাযার টাকা দিয়ে বড় গরুর ভাগী হন। কিন্তু তার অর্ধেক টাকা দিয়ে একটি ছাগল কিনতে রাযী নন। এর দ্বারা কি বুঝা যায়? ‘কুরবানী’ হ’ল পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত। যা তিনি পুত্র ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে করেছিলেন। আর তা ছিল আল্লাহ্র পক্ষ হ’তে পাঠানো একটি পশুর জীবন অর্থাৎ দুম্বা। এক্ষণে যদি আমরা ভাগা কুরবানী করি, তাহ’লে পশুর হাড়-হাড্ডি ও গোশত ভাগ করতে পারব, কিন্তু তার জীবন ভাগ করতে পারব কি? গোশত সাত জনের ভাগে গেল, কিন্তু পশুর জীবনটা কার ভাগে গেল? অতএব ইবরাহীমী ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হ’তে আল্লাহ্র রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কুরবানী দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়।
(ঘ) ‘কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টিরই উদ্দেশ্য আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিল করা’ এই (ইসতিহসানের) যুক্তি দেখিয়ে কোন কোন হানাফী বিদ্বান কুরবানীর গরু বা উটে এক বা একাধিক সন্তানের আক্বীক্বা সিদ্ধ বলে মত প্রকাশ করেছেন (যা এদেশে অনেকের মধ্যে চালু আছে)।[32] হানাফী মাযহাবের স্তম্ভ বলে খ্যাত ইমাম আবু ইউসুফ (রহঃ) এই মতের বিরোধিতা করেন। ইমাম শাওকানী (রহঃ) এর ঘোর প্রতিবাদ করে বলেন, এটি শরী‘আত। এখানে সুনির্দিষ্ট দলীল ব্যতীত কিছুই প্রমাণ করা সম্ভব নয়।[33] বলা আবশ্যক যে, কুরবানীর পশুতে আক্বীক্বার ভাগ নেওয়ার কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরামের কথা ও কর্মে পাওয়া যায় না। এটা স্রেফ ধারণা ভিত্তিক আমল, যা হানাফী মাযহাবের দোহাই দিয়ে এদেশে চালু হয়েছে। যদিও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) থেকে এ বিষয়ে কোন নির্দেশ নেই। বরং তিনি বলেছেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন হাদীছ ছহীহ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।[34]
(৬) কুরবানী করার পদ্ধতি:
(ক) উট দাঁড়ানো অবস্থায় এর ‘হলক্বূম’ বা কণ্ঠনালীর গোড়ায় কুরবানীর নিয়তে‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লাহু আকবার’ বলে অস্ত্রাঘাতের মাধ্যমে রক্ত প্রবাহিত করে ‘নহর’ করতে হয় এবং গরু বা ছাগলের মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে বাম কাতে ফেলে ‘যবহ’ করতে হয়।[35] কুরবানী দাতা ধারালো ছুরি নিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ পড়ে নিজ হাতে খুব জলদি যবহের কাজ সমাধা করবেন, যেন পশুর কষ্ট কম হয়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজের ডান পা দিয়ে পশুর ঘাড় চেপে ধরতেন। যবহকারী বাম হাত দ্বারা পশুর চোয়াল চেপে ধরতে পারেন। ছুরি ধার করা ছাড়াও যবহের কাজ এমনকি ঋতুবতী মেয়েদের দ্বারাও করানো জায়েয।[36]
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে কুরবানী যবহ করেছেন। অন্যের দ্বারা যবহ করানো জায়েয আছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতটি নিজ হাতে করা অথবা যবহের সময় স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা উত্তম। হাকেম ও বায়হাক্বীর একটি যঈফ সূত্র অনুযায়ী আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ) এ মর্মে কন্যা ফাতেমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।[37]
(গ) ১০, ১১, ১২ যিলহাজ্জ তিনদিনের রাত-দিন যে কোন সময় কুরবানী করা যাবে।[38] তবে অনেক ছাহাবী, ইমাম শাফেঈ ও বহু বিদ্বানের মতে ঈদুল আযহার পরের তিনদিন কুরবানী করা যাবে। ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী এটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন।[39]অনেকে সন্ধ্যার পরে কুরবানী করা নাজায়েয মনে করেন। এটা ঠিক নয়।
(ঘ) যদি যবহকারী ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে যান, তাহ’লেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না।[40]
(৭) যবহকালীন দো‘আ:
(১) বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার (অর্থঃ আল্লাহ্র নামে, আল্লাহ মহান) (২) বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ হ’তে)।
এখানে কুরবানী অন্যের হ’লে তার নাম মুখে বলবেন অথবা মনে মনে নিয়ত করে বলবেন‘বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন ফুলান ওয়া মিন আহলে বায়তিহী’ (আল্লাহ্র নামে, হে আল্লাহ! তুমি কবুল কর অমুকের ও তার পরিবারের পক্ষ হ’তে)। এই সময় নবীর উপরে দরূদ পাঠ করা মাকরূহ’।[41] (৩) ‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী কামা তাক্বাববালতা মিন ইবরাহীমা খালীলিকা’ (…হে আল্লাহ! তুমি আমার পক্ষ হ’তে কবুল কর যেমন কবুল করেছ তোমার দোস্ত ইবরাহীমের পক্ষ থেকে)।[42] (৪) যদি দো‘আ ভুলে যান বা ভুল হবার ভয় থাকে, তবে শুধু‘বিসমিল্লাহ’ বলে মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে।[43] (৫) উপরোক্ত দো‘আগুলির সাথে অন্য দো‘আও রয়েছে। যেমন ‘ইন্নী ওয়াজ্জাহ্তু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরযা ‘আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানীফাঁও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না ছালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রবিবল ‘আলামীন। লা শারীকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা; (মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী) বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’।[44]
(৮) ঈদের ছালাত ও খুৎবা শেষ হওয়ার পূর্বে কুরবানী করা নিষেধ। করলে তাকে তদস্থলে আরেকটি কুরবানী দিতে হবে।[45]
(৯) গোশত বন্টন: জাহেলী আরবরা কা‘বার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীত পশুর গোশত নিজেরা খেত না। বরং সবটুকু ছাদক্বা করে দিত।[46] ইসলাম আসার পরে আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবহকৃত কুরবানীর পশুর গোশত নিজেরা খাওয়ার ও অন্যকে খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে বলা হয় فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ ‘অতঃপর তোমরা তা থেকে নিজেরা খাও এবং অন্যদের খাওয়াও যারা চায় না ও যারা চায়’ (হজ্জ ২২/৩৬)। অন্য আয়াতে এসেছে, فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ ‘আর তোমরা খাও এবং খাওয়াও দুস্থ-অভাবীদেরকে’ (হজ্জ ২২/২৮)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) কুরবানীর গোশত তিনভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারকে খাওয়াতেন ও একভাগ অভাবী প্রতিবেশীদের দিতেন ও একভাগ সায়েলদের মধ্যে ছাদাক্বা করতেন’।[47] অতএব কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজ পরিবারের খাওয়ার জন্য, এক ভাগ অভাবী প্রতিবেশী যারা কুরবানী করতে পারেনি তাদের জন্য হাদিয়া স্বরূপ ও একভাগ সায়েল ফক্বীর-মিসকীনদের মধ্যে ছাদাক্বা স্বরূপ বিতরণ করবে (নায়ল ৬/২৫৪)। প্রয়োজনে উক্ত বন্টনে কমবেশী করায় কিংবা সবটুকু বিতরণ করায় কোন দোষ নেই।[48]
বন্টন বিষয়ে উত্তম হ’ল, মহল্লার স্ব স্ব কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ এক স্থানে জমা করে মহল্লায় যারা কুরবানী করতে পারেনি, তাদের তালিকা করে তাদের মধ্যে সুশৃংখলভাবে বিতরণ করা এবং প্রয়োজনে তাদের বাড়ীতে কুরবানীর গোশত পৌঁছে দেওয়া। বাকী এক তৃতীয়াংশ সায়েল ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করা।
আল্লাহ্র নামে উৎসর্গীত কুরবানীর পবিত্র গোশত মুসলিমদের মধ্যেই বিতরণ করা উত্তম। তবে অমুসলিম প্রতিবেশী দুস্থ-অভাবীদের কিছু দেওয়ায় দোষ নেই। কেননা এটি যাকাত বহির্ভূত নফল ছাদাক্বার অন্তর্ভুক্ত।[49] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) তাঁর ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়েই গোশত বন্টন শুরু করেছিলেন।[50] ‘তোমরা মুসলমানদের কুরবানী থেকে মুশরিকদের আহার করাইয়ো না’ মর্মে যে হাদীছ এসেছে সেটি ‘যঈফ’।[51]
(১০) গোশত সংরক্ষণ : কুরবানীর গোশত যতদিন খুশী রেখে খাওয়া যায়। এমনকি ‘এক যুলহিজ্জাহ থেকে আরেক যুলহিজ্জাহ পর্যন্ত’ এক বছর।[52] তবে মহল্লায় অভাবীর সংখ্যা বেশী থাকলে বা দেশে ব্যাপক অভাব দেখা দিলে তিনদিনের পর গোশত সবটুকু বিতরণ করা যরূরী।[53]
(১১) মৃত ব্যক্তির নামে পৃথকভাবে কুরবানী দেওয়ার কোন ছহীহ দলীল নেই। হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অছিয়ত হিসাবে তাঁর জন্য পৃথক একটি দুম্বা কুরবানী দিয়েছেন বলে তিরমিযী শরীফের যে হাদীছটি মিশকাতে (হা/১৪৬২) এসেছে, তা নিতান্তই যঈফ। অন্য কোন ছাহাবী রাসূলের জন্য বা কোন মৃত ব্যক্তির জন্য এভাবে কুরবানী দিয়েছেন বলে জানা যায় না। মৃত ব্যক্তিগণ পরিবারের সদস্য থাকেন না এবং তাদের উপরে শরী‘আত প্রযোজ্য নয়। অথচ কুরবানী হয় জীবিত ব্যক্তি ও পরিবারের পক্ষ হ’তে। এক্ষণে যদি কেউ মৃতের নামে কুরবানী করেন, তবে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হিঃ) বলেন, তাকে সবটুকুই ছাদাক্বা করে দিতে হবে।[54]
(১২) কুরবানীর গোশত বিক্রি করা নিষেধ। তবে তার চামড়া বিক্রি করে[55] শরী‘আত নির্দেশিত ছাদাক্বার খাত সমূহে ব্যয় করবে (তওবা ৬০)। এগুলি মহল্লায় বায়তুল মাল ফান্ডে জমা করে আল্লাহ ভীরু বিশ্বস্ত মুতাওয়াল্লীর মাধ্যমে সুশৃংখল ভাবে সুষ্ঠু পরিকল্পনার সাথে ব্যয় করা উত্তম। আজকাল বড় বড় শহরে পেশাদার ভিক্ষুক ও তাদের সহযোগীদের দেখা যায় অনেক পরিমাণ কুরবানীর গোশত সংগ্রহ করে তা পরে কম দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে। এ ধরনের দুষ্কর্ম থেকে এখুনি তওবা করা উচিত। মনে রাখা ভাল যে, আল্লাহ্র ন্যায় বিচারে ধনী-গরীব কেউ ছাড় পাবে না।
(১৩) কুরবানীর পশু যবহ করা কিংবা কুটা-বাছা বাবদ কুরবানীর গোশত বা চামড়ার পয়সা হ’তে কোনরূপ মজুরী দেওয়া যাবে না। ছাহাবীগণ নিজ নিজ পকেট থেকে এই মজুরী দিতেন। অবশ্য ঐ ব্যক্তি দরিদ্র হ’লে হাদিয়া স্বরূপ তাকে কিছু দেওয়ায় দোষ নেই।[56]
(১৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ঈদুল ফিৎরের দিন কয়েকটি বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদগাহে বের হ’তেন এবং ঈদুল আযহার দিন ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত কিছুই খেতেন না।[57]তিনি কুরবানীর পশুর কলিজা দ্বারা ইফতার করতেন।[58]
দুর্ভাগ্য, বর্তমানে ঈদুল আযহাতে সকাল থেকে সেমাই-জর্দার ধুম পড়ে যায়। অথচ এটা সুন্নাত বিরোধী কাজ। মা-বোনদের এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া উচিত।
(১৫) কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করা নাজায়েয। আল্লাহ্র রাহে রক্ত প্রবাহিত করাই এখানে মূল ইবাদত। যদি কেউ কুরবানীর বদলে তার মূল্য ছাদাক্বা করতে চান, তবে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আতের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবেন।[59] ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, কুরবানী ছাদাক্বার চাইতে উত্তম, যেমন ঈদের ছালাত অন্য সকল নফল ছালাতের চাইতে উত্তম।[60]
(১৬) কুরবানীর অন্যান্য মাসায়েল:
(ক) পোষা বা খরিদ করা কোন পশুকে কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা দিলে তা আর বদল করা যাবে না। অবশ্য যদি নির্দিষ্ট না করে থাকেন, তবে তার বদলে উত্তম পশু কুরবানী দেওয়া যাবে। (খ) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট গাভিন গরু বা বকরী যদি কুরবানীর পূর্বেই জীবিত বাচ্চা প্রসব করে, তবে ঐ বাচ্চা ঈদের দিনগুলির মধ্যেই কুরবানী করবে। কুরবানীর পূর্ব পর্যন্ত বাচ্চার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দুধ মালিক পান করতে পারবে বা তার বিক্রয়লব্ধ পয়সা নিজে ব্যবহার করতে পারবে। তবে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর মতে দুধ বা দুধ বিক্রির পয়সা ছাদাক্বা করে দেওয়া ভাল। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট না করলে ও সেই মর্মে ঘোষণা না দিলে, সেটাকে যবহ করাও যেতে পারে, রেখে দেওয়াও যেতে পারে। (গ) যদি কুরবানীর পশু হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়, তবে তার পরিবর্তে অন্য কুরবানী যরূরী নয়। যদি ঐ পশু ঈদুল আযহার দিন বা পরে পাওয়া যায়, তবে তা তখনই আল্লাহ্র রাহে যবহ করে দিতে হবে। (ঘ) যদি কুরবানীর পূর্বে কুরবানী দাতা মৃত্যুবরণ করেন এবং তার অবস্থা এমন হয় যে, ঐ পশু বিক্রয়লব্ধ পয়সা ভিন্ন তার ঋণ পরিশোধের আর কোন উপায় নেই, তখন কেবল ঋণ পরিশোধের স্বার্থেই কুরবানীর পশু বিক্রয় করা যাবে।[61]
[2]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১৪৭৯; মির‘আত হা/১৪৯৩, ৫/১১৭ পৃঃ; ‘আতীরাহ’ অনুচ্ছেদ; হাকেম (বৈরুতঃ তাবি), ৪/২২৩ পৃঃ। হাকেম একে ছহীহ বলেছেন ও যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। তবে শায়খ আলবানী বলেন, অত্র হাদীছের সনদে ঈসা ইবনে হেলাল আছ-ছাদাফী রয়েছেন। ‘যার ব্যাপারে আমার নিকটে অপরিচিতি রয়েছে (فيه عندى جهالة)’। ইবনু আবী হাতেম এ বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে ইবনু হিববান তাঁকে বিশ্বস্ত বলেছেন। যদিও কাউকে বিশ্বস্ত বলার ব্যাপারে তাঁর উদারতা সুপরিচিত’। দ্রঃ ঐ, মিশকাত ১/৪৬৬ পৃঃ টীকা-২
[7]. শাওকানী, আস-সায়লুল জাররার (বৈরুত ছাপাঃ তারিখ বিহীন), ৪/৮৮ পৃঃ; ছান‘আনী, সুবুলুস সালাম শরহ বুলূগুল মারাম (কায়রো ছাপাঃ ১৪০৭/১৯৮৭) ৪/১৮৫ পৃঃ; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।
[9]. বায়হাক্বী ৯/২৬৮; মিশকাত হা/১৪৬১; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫), ৪/৩৫১ সনদ ‘হাসান’।
[13]. মুওয়াত্ত্বা, তিরমিযী প্রভৃতি মিশকাত হা/১৪৬৫, ১৪৬৩, ১৪৬৪; ফিক্বহুস সুন্নাহ (কায়রো ছাপাঃ ১৪১২/১৯৯২) ২/৩০ পৃঃ।
[19]. তিরমিযী, আবু দাঊদ প্রভৃতি, মিশকাত হা/১৪৭৮; মির‘আত হা/১৪৯২, ৫/১১৪-১৫ পৃঃ। হাদীছটির সনদ ‘শক্তিশালী’ (ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী ১০/৬ পৃঃ); সনদ ‘হাসান’ আলবানী, ছহীহ নাসাঈ (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/৩৯৪০; ছহীহ আবুদাউদ (বৈরুতঃ ১৯৮৯), হা/২৪২১; ছহীহ তিরমিযী (বৈরুতঃ ১৯৮৮) হা/১২২৫; ছহীহ ইবনু মাজাহ (বৈরুতঃ ১৯৮৯) হা/২৫৩৩। ইমাম তিরমিযী ও বাগাভী বলেন, চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম ও পৃথক মাস হিসাবে রজব মাসের সম্মানে লোকেরা যে কুরবানী করত, তাকে ‘আতীরাহ’ বা ‘রাজীবাহ’ বলা হ’ত (শারহুস সুন্নাহ, বৈরুত: ১৪০৩/১৯৮৩) হা/১২২৮-এর ব্যাখ্যা, ৪/৩৫০ পৃঃ; মির‘আত ৫/১১১ পৃঃ)। শাওকানী বলেন, প্রতি বছর রজব মাসের প্রথম দশকে যে কুরবানী করা হ’ত, তাকেই ‘রাজীবাহ’ বা ‘আতীরাহ’ বলা হয়। ইমাম নবভী বলেন, আতীরাহ্র এই ব্যাখ্যায় সকল বিদ্বান একমত হয়েছেন’ (নায়ল ৬/২৭০ পৃঃ)।
[24]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৫৩; বুখারী (মীরাট ছাপাঃ ১৩২৮ হিঃ) ১/২৩১ পৃঃ; ছহীহ আবূদাঊদ হা/১৫৩৯ ।
Pingback: আমাদের এলাকায় কুরবানীর গোশত এক-তৃতীয়াংশ পঞ্চায়েতে জমা করার পর সেখান থেকে গরীবদের মাঝে বিতরণ করা