শবেবরাতের ছালাত
এই রাত্রির ১০০ রাক‘আত ছালাত সম্পর্কে যে হাদীছ বলা হয়ে থাকে তা ‘মওযূ’ বা জাল। এই ছালাত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে আবিষ্কৃত হয়। যেমন মিশকাত শরীফের খ্যাতনামা আরবী ভাষ্যকার মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (মৃঃ ১০১৪ হিঃ) اللآلى কেতাবের বরাতে বলেন, ‘জুম‘আ ও ঈদায়নের ছালাতের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ‘ছালাতে আল্ফিয়াহ’ নামে এই রাতে যে ছালাত আদায় করা হয় এবং এর স্বপক্ষে যেসব হাদীছ ও আছার বলা হয়, তার সবই বানোয়াট ও মওযূ অথবা যঈফ। এব্যাপারে (ইমাম গায্যালীর) ‘এহ্ইয়াউল উলূম’ ও (ইবনুল আরাবীর) ‘কূতুল ক্বুলূব’ দেখে যেন কেউ ধোকা না খায়।… এই বিদ‘আত ৪৪৮ হিজরীতে সর্বপ্রথম জেরুযালেমের বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদে প্রবর্তিত হয়। মসজিদের মূর্খ ইমামগণ অন্যান্য ছালাতের সঙ্গে যুক্ত করে এই ছালাত চালু করে। এর মাধ্যমে তারা জনসাধারণকে একত্রিত করার এবং মাতববরী করা ও পেট পুর্তি করার একটা ফন্দি এঁটেছিল মাত্র। এই বিদ‘আতী ছালাতের ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে নেক্কার-পরহেযগার ব্যক্তিগণ আল্লাহর গযবে যমীন ধ্বসে যাওয়ার ভয়ে শহর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিলেন’।১৭ এই রাতে মসজিদে গিয়ে একাকী বা জামা‘আতবদ্ধভাবে ছালাত আদায় করা, যিক্র-আযকারে লিপ্ত হওয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, শামের কিছু বিদ্বান এটা প্রথমে শুরু করেন। তাঁরা এই রাতে সুন্দর পোষাক পরে, আতর-সুরমা লাগিয়ে মসজিদে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করতে থাকেন। পরে বিষয়টি লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মক্কা-মদীনার আলেমগণ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। কিন্তু শামের
১৬. মুসলিম (নববীসহ) ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৬৮।
১৭. মিরক্বাত (দিল্লীঃ তাবি) ‘ক্বিয়ামু শাহরে রামাযান’ অধ্যায়, টীকা (সংক্ষেপায়িত), ৩য় খন্ড, পৃঃ ১৯৭-৯৮।
বিদ্বানদের দেখাদেখি কিছু লোক এগুলো করতে শুরু করেন। এইভাবে এটি জনসাধারণ্যে ব্যপ্তি লাভ করে’।১৮ বুঝা গেল যে, শবেবরাত উপলক্ষ্যে বিশেষ ছালাত বা ইবাদত অনুষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে নব্যসৃষ্ট বা বিদ‘আত। এর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বা ছাহাবায়ে কেরামের সুন্নাতের কোন সম্পর্ক নেই। তবুও লোকেরা এ কাজ করে থাকেন। তার পিছনে সম্ভবতঃ দু’টি কারণ ক্রিয়াশীল রয়েছে।-
১- এই উপলক্ষ্যে ছালাত ছিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত অনুষ্ঠান মূলতঃ বিদ‘আত হ’লেও কাজগুলো তো ভাল। অতএব ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ বা সুন্দর বিদ‘আত হিসাবে করলে দোষ কি? এর জওয়াব হ’ল এই যে, ইসলামী শরী‘আত কোন মানুষের তৈরী নয়। বরং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট। এর ইবাদত বিষয়ের সবটুকুই শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত। যেখানে সামান্যতম কমবেশী করার অধিকার কারু নেই। আর শরী‘আতের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করাকেই তো বিদ‘আত বলা হয়। সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা। যার পরিণাম জাহান্নাম। তাই এ থেকে প্রত্যেক মুসলমানের দূরে থাকা অপরিহার্য। মাদরাসা, মকতব, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি ব্যবহারিক বিষয়গুলি শরী‘আতের পরিভাষায় বিদ‘আত নয়। তাই ‘বিদ‘আতে হাসানাহ’ নাম দিয়ে ধর্মের নামে সৃষ্ট শবেবরাত-কে জায়েয করা চলে না।
২য়- আরেকটি বিষয় হ’ল মধ্য শা‘বানের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে কোন ছহীহ হাদীছ না থাকলেও অনেকগুলি যঈফ ও মওযূ হাদীছ যেহেতু আছে, সেহেতু ‘ফাযায়েল’ সংক্রান্ত ব্যাপারে যঈফ হাদীছের উপরে আমল করায় দোষ নেই। এর জওয়াব এই যে, যঈফ হাদীছের উপরে কোন দলীল কায়েম করা সিদ্ধ নয়। তবু বর্ণিত যুক্তিটি মেনে নিলেও তা কেবল ঐসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, যেসব আমলের পিছনে কোন ছহীহ ও সুদৃঢ় দলীল মওজুদ আছে। শবেবরাতের পিছনে এই ধরনের কোন ছহীহ দলীল নেই। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বরং এর বিরোধী বক্তব্যই আমরা ইতিপূর্বে শ্রবণ করে এসেছি। তাছাড়া শবেবরাত কেবল ফাযায়েল-এর অনুষ্ঠান নয় বরং রীতিমত ইবাদত অনুষ্ঠান,
১৮. আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, ‘আত-তাহযীরু মিনাল বিদ‘আ’ পৃঃ ১২-১৩।
যার কোন ভিত্তি শরী‘আতে নেই। হাফেয ইরাকী বলেন, মধ্য শা‘বানের বিশেষ ছালাত সম্পর্কিত হাদীছসমূহ মওযূ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যারোপ মাত্র। ইমাম নবভী (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন, ‘ছালাতে রাগায়েব’ নামে পরিচিত ১২ রাক‘আত ছালাত, যা মাগরিব ও এশার মধ্যে পড়া হয় এবং রজব মাসের প্রথম জুম‘আর রাত্রিতে ও মধ্য শা‘বানের রাত্রিতে ১০০ রাক‘আত ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে, এগুলি বিদ‘আত ও মুনকার।… এই ছালাতগুলি সম্পর্কে যত হাদীছ বর্ণনা করা হয়ে থাকে সবই বাতিল। কোন কোন আলেম এগুলিকে ‘মুস্তাহাব’ প্রমাণ করতে গিয়ে যে কিছু পৃষ্ঠা খরচ করেছেন, তারাও এ ব্যাপারে ভুলের মধ্যে আছেন’।১৯
১৯. আত-তাহযীর, পৃঃ ১৪।