রূহের আগমন
এই রাত্রিতে ‘বাক্বী‘এ গারক্বাদ’ নামক কবরস্থানে রাতের বেলায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিঃসঙ্গ অবস্থায় যেয়ারত করতে যাওয়ার হাদীছটি (ইবনু মাজাহ হা/১৩৮৯) যে যঈফ ও মুনক্বাত্বা‘ তা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। এখন প্রশ্ন হ’লঃ এই রাতে সত্যি সত্যিই রূহগুলো ইল্লীন বা সিজ্জীন হ’তে সাময়িকভাবে ছাড়া পেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে কি-না। যাদের মাগফেরাত কামনার জন্য আমরা দলে দলে কবরস্থানের দিকে ছুটে যাই। এমনকি মেয়েদের জন্য কবর যেয়ারত অসিদ্ধ হ’লেও তাদেরকেও এ রাতে কবরস্থানে দেখা যায়। এ সম্পর্কে সাধারণতঃ সূরায়ে ক্বদর-এর ৪ ও ৫নং আয়াত দু’টি পেশ করা হয়ে থাকে। যেখানে বলা হয়েছে-
تَنَزَّلُ الْملآئِكَةُ وَالرُّوْحُ فِيْهَا بِإذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ اَمْرٍ، سَلامٌ، هِىَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ-
অর্থঃ ‘সে রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। সকল বিষয়ে কেবল শান্তি; ঊষার আর্বিভাব কাল পর্যন্ত’। এখানে ‘সে রাত্রি’ বলতে লায়লাতুল ক্বদর বা শবেক্বদরকে বুঝানো হয়েছে- যা এই সূরার ১ম, ২য় ও ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে।
১৯. আত-তাহযীর, পৃঃ ১৪।
অত্র সূরায় ‘রূহ’ অবতীর্ণ হয় কথাটি রয়েছে বিধায় হয়তবা অনেকে ধারণা করে নিয়েছেন যে, মৃত ব্যক্তিদের রূহগুলি সব দুনিয়ায় নেমে আসে। অথচ এই অর্থ কোন বিদ্বান করেননি। ‘রূহ’ শব্দটি একবচন। এ সম্পর্কে হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে রূহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার জিবরাঈলকে বুঝানো হয়েছে। কেউ বলেন, বিশেষ ধরনের এক ফিরিশতা। তবে এর কোন ছহীহ ভিত্তি নেই’।২০
বুঝা গেল যে, ক্বদরের রাত্রিতে জিব্রীল (আঃ) তাঁর বিশেষ ফিরিশতা দল নিয়ে দুনিয়াতে অবতরণ করেন এবং মুমিনদের ছালাত, তেলাওয়াত, যিক্র-আযকার ইত্যাদি ইবাদতের সময় রহমতের পাখা বিছিয়ে তাদেরকে ঘিরে থাকেন। এর সঙ্গে মৃত লোকদের রূহ ফিরে আসার কোন সম্পর্ক নেই। অতএব মহিমান্বিত শবেক্বদরে যখন মৃত রূহগুলো ফিরে আসে না, তখন শবেবরাতে এগুলো ফিরে আসার যুক্তি কোথায়? এ বিষয়ে কোন ছহীহ দলীল থাকলে তা অবশ্যই মানতে হ’ত। কিন্তু তেমন কিছুই নেই। এমতাবস্থায় ঐসব রূহের সম্মানে আগরবাতি, মোমবাতি বা রং-বেরংয়ের বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা, তাদের মাগফেরাত কামনার জন্য দলে দলে কবর যেয়ারত করা, ভাগ্যরজনী মনে করে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা এবং এই উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন মাহফিল ও সকল প্রকারের অনুষ্ঠানই বিদ‘আত-এর পর্যায়ভুক্ত হবে। বরং অহেতুক অর্থ ও সময়ের অপচয়ের জন্য এবং বিদ‘আতের সহায়তা করার জন্য আল্লাহর গযবের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আবদুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী (৯৫৮-১০৫২ হিঃ)-এর মতে এই রাতে আলোকসজ্জা করা হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ উৎসবের অনুকরণ মাত্র’। কেউ বলেন, এগুলি খলীফা হারূনুর রশীদ (১৭০-১৯৩ হিঃ)-এর অগ্নি উপাসক নও মুসলিম বারামকী মন্ত্রীদের চালু করা বিদ‘আত মাত্র’।২১
পরিশেষে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেই আলোচনার ইতি টানতে চাই। কোন একটি নির্দিষ্ট রাত্রি বা দিবসকে শুভ বা অশুভ গণ্য করা ইসলামী নীতির বিরোধী। রাত্রি ও দিবসের স্রষ্টা আল্লাহ। তাই কোন একটি রাত বা দিনকে অধিক মঙ্গলময় হিসাবে গণ্য করতে গেলে সেখানে
২০. ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআন (বৈরুতঃ ১৯৮৮) ৪র্থ খন্ড, পৃঃ ৪৯৬, ৫৬৮।
২১. তুহফাতুল আহওয়াযী (কায়রোঃ ১৯৮৭), ৩য় খন্ড, পৃঃ ৪৪৩।
আল্লাহর নির্দেশ অবশ্যই যরূরী। ‘অহি’ ব্যতীত মানুষ এ ব্যাপারে নিজে থেকে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। যেমন কুরআন ও হাদীছের মাধ্যমে আমরা লায়লাতুল ক্বদর ও মাহে রামাযানের বিশেষ মর্যাদা এবং ঐ সময়ের ইবাদতের বিশেষ ফযীলত সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
এক্ষণে যদি শবেবরাত, শবেমে‘রাজ, জুম‘আতুল বিদা‘ ইত্যাদির বিশেষ কোন ফযীলত এবং বিশেষ ইবাদত সম্পর্কে কিছু থাকত, তবে তা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অবশ্যই তাঁর ছাহাবীদেরকে জানিয়ে যেতেন। তিনি নিজে করতেন ও তাঁর ছাহাবীগণও তার উপরে আমল করতেন। শুধু নিজেরা আমল করতেন না, বরং মুসলিম উম্মাহর নিকটে তা প্রচার করে যেতেন এবং তা কখনোই গোপন রাখতেন না। কারণ তাঁরাই ইসলামের প্রথম কাতারের বাস্তব রূপকার। তাঁরাই দ্বীনকে এ দুনিয়ায় সর্বাধিক ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। আল্লাহ তাঁদের উপর রহম করুন- আমীন! কিন্তু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে এসবের কিছুই পাওয়া যায় না। বরং একথাই পাওয়া যায় যে, জুম‘আর দিন রাত হ’ল সবচেয়ে সম্মানিত। অথচ জুম‘আর রাতকে ইবাদতের জন্য এবং দিনকে ছিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করা নিষেধ’।২২ অতএব ছহীহ দলীল ব্যতীত কোন একটি রাত বা দিনকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করা কিভাবে জায়েয হ’তে পারে, সুধী পাঠকমন্ডলী তা ভেবে দেখবেন আশা করি। পরিশেষে বহুল প্রচারিত বাংলা বই ‘মকছুদুল মোমেনীন’ (১৯৮৫) পৃঃ ২৩৫-২৪২ ইবং ‘মকছুদুল মোমীন’ (১৯৮৫) ৪০২-৪০৮ পৃষ্ঠায় শবেবরাতের ফযীলত বলতে গিয়ে হাদীছের নামে যে ১৬টি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
২২. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৫২।